Pray for the world economy

আবু হুরায়রা(রা.) এর "সংক্রমণ নেই" হাদিস ভুলে যাওয়া প্রসঙ্গঃ আলোচ্য হাদিসের প্রকৃত ব্যাখ্যা কী?

 

নাস্তিক-মুক্তমনারা সহীহ মুসলিম থেকে একটি হাদিস দেখিয়ে সাধারণ মুসলিমদের উদ্যেশ্যে সংশয় সৃষ্টির জন্য বলেঃ আবু হুরায়রা(রা.) হাদিসটি ভুলে যাবার দরুণ নাকি এটা প্রমাণ হয় - ঐ হাদিসের ব্যাখ্যা নিয়ে সাহাবীদের মধ্যে বিতর্ক ছিলো! তারা সেই হাদিস উল্লেখ করে আবু হুরায়রা(রা.) এর নামে অপবাদ দেবার চেষ্টা করে। তারাও এটাও প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে, ইসলামে নাকি রোগ সংক্রমণের (আল্লাহসৃষ্ট) প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াটি অস্বীকার করা হয়েছে। সেই হাদিসটি এখানে উল্লেখ করা হলো এবং সহীহ মুসলিমের সব থেকে প্রসিদ্ধ শারহ (ব্যাখ্যা) গ্রন্থ ইমাম নববী(র.) এর শারহ মুসলিম থেকে আলোচ্য হাদিসের ব্যাখ্যা উল্লেখ করা হলো। যা থেকে বোঝা যাবে আলোচ্য হাদিসের ব্যাপারে প্রাচীন মুসলিমদের মধ্যে প্রচলিত সব থেকে প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যা কী ছিলো।

 

হাদিসঃ

আবূ সালামা ইবনু আবদুর রহমান ইবনু আওফ (রা.) থেকে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেনঃ সংক্রমণ (-এর অস্তিত্ব) নেই। তিনি আরও হাদীস বর্ণনা করতেন যে, রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেনঃ অসুস্থ উটপালের মালিক (অসুস্থ উটগুলিকে) সুস্থ উটপালের মালিকের (উটের) কাছে আনবে না। আবূ সালামা (র.) বলেন, আবূ হুরায়রা (রা.) এ দু'টি হাদীস রাসুলুল্লাহ(ﷺ) থেকে বর্ণনা করতেন। পরে আবূ হুরায়রা (রা.) তাঁর (প্রথম হাদীসের) ‘সংক্রমণ ...... নেই’ বলা থেকে নিরব থাকেন এবং অসুস্থ উটপালের মালিক সুস্থ উটপালের মালিকের কাছে আনবেনা এর বর্ণনায় দৃঢ় থাকেন।

 

রাবী বলেনঃ (একদিন) হারিস ইবনু আবূ যুবাব (র.), তিনি আবূ হুরায়রা (রা.) এর চাচাত ভাই, বললেন, হে আবূ হুরায়রা! আমি তে শুনতে পেতাম যে, আপনি এ হাদীসের সাথে আরও একটি হাদীস আমাদের কাছে রিওয়াত করতেন যা বর্ণনায় আপনি এখন নীরব থাকছেন। আপনি বলতেন যে, রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেনঃ সংক্রমণ ...... নেই। তখন আবূ হুরায়রা (রা.) তা মেনে নিতে অস্বীকার করলেন এবং বললেন, অসুস্থ পালের মালিক সুস্থপালের মালিকের কাছে নিয়ে যাবে না। তখন হারিস (র.) এ ব্যাপারে তাঁর সাথে বিতর্কে লিপ্ত হলেন। ফলে আবূ হুরায়রা (রা.) রাগাম্বিত হয়ে হাবশী ভাষায় কিছু বললেন।

 

তিনি হাবিস (র.) কে বললেন, তুমি কি বুঝতে পেরেছো, আমি কি বলেছি? তিনি বললেন, না। আবূ হুরায়রা (রা.) বললেন, আমি বলেছি, আমি অস্বীকার করছি। আবূ সালামা (র.) বলেন, আমার জীবনের শপথ। আবূ হুরায়রা (রা.) অবশ্যই আমাদের কাছে হাদীস বর্ণনা করতেন যে, রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেন 'সংক্রমণ ...... নেই'। এখন আমি জানি না যে, আবূ হুরায়রা(রা.) ভুলে গেলেন, নাকি একটি অপরটিকে (মানসুখ) রহিত করে দিয়েছে [1]

 

ইমাম নববী(র.) এর শারহ থেকেঃ

অধিকাংশ আলেম বলেছেন, এই হাদিসগুলোর সমন্বয় করতে হবে। এবং এর উভয়ই সহীহ। তাঁরা বলেনঃ হাদিসগুলো সমন্বয়ের উপায় হচ্ছে, [ لا عدوى - সংক্রমণ নেই ] এই কথার উদ্যেশ্য হলো জাহিলী যুগের ঐ ধারণাকে নাকচ করা যে, অসুস্থতা ও রোগব্যধি নিজ ক্ষমতাতেই সংক্রমিত হতে পারে এবং এর পেছনে আল্লাহ তা’আলার কোনো ক্ষমতা/ক্রিয়া থাকে না। আর যে হাদিসে বলা হয়েছে [ لا يورد ممرض على مصح - রোগাক্রান্তকে যেন সুস্থের সাথে একত্রে না রাখা হয়], সেখানে আমাদেরকে এদিকেই পথনির্দেশ করা হচ্ছে যে, তার (রোগাক্রান্তের) নিকটবর্তী হলে খুব স্বাভাবিকভাবেই আল্লাহ তা’আলার ক্ষমতা এবং নির্ধারণের (তাকদির) দ্বারা সে আক্রান্ত হতে পারে। এটি থেকে যেন বিরত থাকা হয়।

 

তাঁরা (অধিকাংশ আলেম) বলেছেন, ১ম হাদিসের উদ্যেশ্য হলো রোগ নিজে নিজে (আল্লাহর ইচ্ছা ও অনুমতি ব্যতিত) সংক্রমিত হতে পারে - এই ধারণাকে নাকচ করা। এ হাদিসের উদ্যেশ্য এই ব্যাপারকে নাকচ করা নয় যে, তার (রোগাক্রান্তের) নিকটবর্তী হলে আল্লাহ তা’আলার ক্ষমতা এবং নির্ধারণের দ্বারা সে রোগাক্রান্ত হতে পারে। আর ২য় হাদিসে এদিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, তার (রোগাক্রান্ত) নিকটবর্তী হবার দ্বারা আল্লাহর ক্ষমতা, ইচ্ছা ও নির্ধারণের দ্বারা সে যে রোগাক্রান্ত হতে পারে, তা থেকে সাবধান থাকতে হবে।

 

আমরা এখানে সহীহ হাদিসগুলোর সমন্বয়ের ব্যাপারে যা আলোচনা করলাম, এটিই হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেমের অনুসৃত সঠিক পন্থা। এবং বিষয়টি এদিকেই নির্দিষ্ট করতে হবে।

আবু হুরায়রা(রা.) যে হাদিসের একটি কথা [ ولا عدوى – এবং সংক্রমণ নেই] ভুলে গিয়েছিলেন, এই ব্যাপারটি কোনো প্রভাব সৃষ্টি করে না ২টি কারণেঃ

প্রথমত, অধিকাংশ আলেমের মতে বর্ণনাকারীর এই নিজ বর্ণনাকৃত হাদিস ভুলে যাওয়া সেই হাদিসের সহীহ হওয়াকে ত্রুটিযুক্ত করে না। বরং এর (হাদিসের) উপর আমল করা ওয়াজিব হয়ে যায়।

দ্বিতীয়ত, হাদিসের এই কথাটি [সংক্রমণ নেই] আবু হুরায়রা(রা.) ছাড়াও অন্যান্যদের রেওয়ায়েত দ্বারা প্রমাণিত। ইমাম মুসলিম(র.) এটি সাইব বিন ইয়াযিদ(রা.), জাবির বিন আব্দুল্লাহ(রা.), আনাস বিন মালিক(রা.), ইবন উমার(রা.) প্রমুখের থেকে রাসুল(ﷺ) এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন।

 

মাযিরী(র.), কাযী ইয়ায(র.) প্রমুখ কিছু আলেম থেকে এই হাদিসের [ لا يورد ممرض على مصح - রোগাক্রান্তকে যেন সুস্থের সাথে একত্রে না রাখা হয়] ব্যাপারে উল্লেখ করেছেন যে, এটি এই হাদিসকে মানসুখ করে দিয়েছে [ لا عدوى - সংক্রমণ নেই ]। কিন্তু এই কথা সঠিক নয় ২টি কারণে।

প্রথমত, নাসেখের একটি লক্ষণ হলো উভয় হাদিসের মধ্যে সমন্বয় করা অসম্ভব হয়ে যায়। কিন্তু এখানে তেমন কিছুই হয়নি। আমরা এদেরকে সমন্বয় করেছি।

দ্বিতীয়ত, এর আরেকটি লক্ষণ হলো ইতিহাসটি (অর্থাৎ কোনটি নাসেখ আর কোনটি মানসুখ) জানা থাকা। নাসেখের ইতিহাসটি জানা থাকা। কিন্তু এখানে এর কোনোটিই নেই।

 

কেউ কেউ বলেছেন, [ لا عدوى - সংক্রমণ নেই ] হাদিসের অর্থ এর যাহির (বা বাহ্যিক অর্থ) এর উপর নিতে হবে। তাদের মতে, لا يورد ممرض على مصح [রোগাক্রান্তকে যেন সুস্থের সাথে একত্রে না রাখা হয়] এই আদেশের কারণ রোগের সংক্রমণ নয়। বরং তা রোগীর দুর্গন্ধে কষ্ট হতে পারে এবং তার কদাকার চেহারা হয়ে যাবার কারণে। কিন্তু (এটি সঠিক মত নয়) আমরা শুরুতে যে মতটি উল্লেখ করেছিলাম, সেটিই সঠিক অভিমত। আল্লাহই সর্বোত্তম জানেন। [2]

 

[ইমাম নববী(র.) এর ব্যাখ্যা সমাপ্ত]

 

এ থেকে বোঝা গেলো যে হাদিসটির অর্থ নিয়ে সাহাবীদের মধ্যে এমন কোনো বিতর্ক ছিলো না। শুধু সহীহ মুসলিমেই অনেক সাহাবী থেকে হাদিসটি বর্ণিত আছে। আবু হুরায়রা(রা.) হাদিসের ২টি শব্দ ভুলে গিয়েছিলেন মাত্র। আর সেগুলোও তিনি নিজেই পূর্বে সহীহভাবে বর্ণনা করেছেন। কাজেই এটি হাদিসের শুদ্ধতার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা সৃষ্টি করে না। মানুষমাত্রই ভুলে যায়। স্বয়ং রাসুল(ﷺ)ও ভুলে যেতেন। [3] ভুলে যান না একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা। যেহেতু আবু হুরায়রা(রা.) ঐ কথাগুলোও পূর্বে বর্ণনা করে গিয়েছেন, কাজেই তাঁর থেকে হাদিসের কোনো অংশ ছুটে যাবার ব্যাপার ঘটেনি। এখানে আবু হুরায়রা(রা.) এর ২টি শব্দ ভুলে যাবার মাঝেও হিকমত রয়েছে। যদিও তিনিও সাধারণত কখনোই হাদিস ভুলে যেতেন না, কিন্তু এই এক স্থানে মাত্র ২টি শব্দ ভুলে যাবার দরুণ তাঁর মধ্য থেকেও মানবীয় গুণাবলি প্রমাণিত হলো। আবারও প্রমাণিত হলো আল্লাহ ছাড়া আর সবাই ভুল করে, ভুলে যায়। তাঁর এই ভুলে যাওয়া আমাদের জন্য একটি শিক্ষনীয় বিষয়। কাজেই এখানে আবু হুরায়রা(রা.)কে কিংবা হাদিসশাস্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করবার চেষ্টা সম্পূর্ণ অসার।

 

আমরা আরো জানলাম যে, আলোচ্য হাদিসে মোটেই রোগ সংক্রমণের (আল্লাহসৃষ্ট) প্রাকৃতিক ব্যাপারটিকে নাকচ করা হয়নি। সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেমদের ব্যাখ্যা আমরা উপরে দেখলাম। নাস্তিক-মুক্তমনারা আলোচ্য হাদিস থেকে মুসলিমদেরকে ঈমানহারা করবার জন্য যেসব কথা বলে থাকে - তা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।

 

 

তথ্যসূত্রঃ

[1] সহীহ মুসলিম (ই.ফা.); হাদিস নং : ৫৫৯৭

https://is.gd/RmrIj4

[2] شرح النووي على مسلم

https://islamweb.net/ar/library/index.php?page=bookcontents&idfrom=6682&idto=6691&bk_no=53&ID=1055

[3] “Reconciling between the verse “We shall make you to recite (the Qur’an), so you (O Muhammad shall not forget (it)” and the fact that the Prophet sometimes forgot when praying and otherwise” islamQA(Shaykh Muhammad Saalih al-Munajjid)

https://islamqa.info/en/184148/